Scroll Top

আপনার পারা না পারা, এই পুরো ব্যাপারটাই মানসিক – বেজবাবা সুমন

বেজবাবা নামে বাংলাদেশি তরুণদের কাছে খুব জনপ্রিয় এই শিল্পী, তাকে নতুন করে আর পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। অভিনব সব উপায়ে বেজ গীটার বাজিয়ে যে মানুষটি মন জয় করেছে হাজারো বাংলাদেশির তার পুরো নাম সাইদুস খালেদ সুমন, সুমন নামে সবাই তাকে এক নামে চিনে। ডন সামদানি ফ্যাসেলিটেশন অ্যাণ্ড কনসালটেন্সি আয়োজিত Rise Above All 2016 তে একটি বক্তব্য রাখেন তিনি। আসুন জেনে নেই তার পথচলার কিছু না জানা তথ্য।

গানের সাথে পথ চলাঃ 

আমি মিউজিক করে চলব, টাকা কামাবো, এটা আমার কখনোই প্ল্যান ছিল না। এটা আমার প্যাশন ছিল।” জানান বেজ যাদুকর সুমন। মিউজিককে কখনোই এতটা গুরুত্ব দেন নি তিনি। কিন্তু পরে যখন উপলব্ধি করেন যে, মানুষ তার গান শুনে পছন্দ করছে তখনই  ‘আরেকটু করি, আরেকটু করি’ করেই মিউজিকের পথে তিনি পা বাড়ান।

সফলতার শীর্ষে পৌঁছানোর প্রথম ধাপঃ 

শুধুমাত্র মিউজিকের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই এতোগুলো বছর মিউজিকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন সুমন। তার মতে, যেকোনো কাজ করার জন্য, উন্নতির শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য কাজটাকে ভালবাসতে হবে। কাজের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে ও আনন্দ না পেলে সত্যি খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, “আপনি যে কাজটা করছেন তা হয়তো আপনার পছন্দের কাজ না। সব কাজেরই একটা নেগেটিভ ও একটি পজিটিভ দিক থাকে। সব জিনিসের মধ্যেই এমন একটা জিনিস থাকবে যা আপনার ভালো লাগবে। সেই ভালো লাগার বিষয়টিকে পুঁজি করে আপনাকে এগিয়ে যেতে হবে। সেই জন্যে খুঁজে বের করতে হবে যে আপনার কোনটা ভালো লাগে।”

 

৫৮ থেকে ৩২!

সুমনের যারা অনেক পুরানো ফ্যান, অথবা যারা ১৯৯০-১৯৯৩ এর দিকে যখন জেমসের সাথে বেজ বাজাতে দেখেছেন, তারা হয়তো জানেন যে তিনি অতিরিক্ত মাত্রায় স্থূল ছিলেন। তার ভাষ্যমতে তার ওজন ছিল ১৭৪ কেজি। কোমরের সাইজ ছিল ৫৮। সারাজীবন এমনই ছিলেন তিনি এবং হাঁটতে, ঘুরতে, ফিরতে, বসতে সবসময় অসুবিধা হত। তিনি বলেন, “সারা জীবন আমার মাথায় একটা জিনিস কাজ করেছে যে, আমি তো কোনদিন শুকাতে পারবো না, এটা অসম্ভব। তো আমি খাওয়া থামাবো কেন? খাই, খেতেই থাকি।”

তবে ২০০৪ সালে অক্টোবরেরে একটি উপলব্ধিতে একটি সিদ্ধান্ত নেন বেজ বাবা ।সিদ্ধান্ত ছিল, যে করেই হোক তাকে নিয়ন্ত্রনে আসতে হবে। এ চিন্তা আগে আসলেও কখনো বাস্তবায়ন করা হয় নি। “দেখা গেছে যে দুই দিন ডায়েট করার পর মনে হল যে দুইদিন তো ডায়েট করেছিই, এখন পুরান ঢাকায় গিয়ে একটু নিহারি খেয়ে আসি।”  এরকম অনেক বার করা সত্ত্বেও এবার তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।  প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে চা ও টোস্ট বিস্কিট খাওয়া হল তার নিত্যদিনের নাস্তা। শসা-গাজর-টমেটো এগুলা কাঁচা চিবিয়ে, রাতে এক বাটি ডাল খেয়ে ইত্যাদি আরও নানা উপায়েই তিনি কমিয়ে আনেন খাওয়া দাওয়া। সুমন বলেন,  “আমি দেড় বছর ভাত এবং রুটি খাই নি।”

দেড় বছর ফল ছিল এরূপঃ ৫৮ সাইজের কোমর এসে দাঁড়ায় ৩২ এ। প্রায় ১০০ কেজি কমিয়েছিলেন সুমন।

বাংলাদেশে এয়ারপোর্টে তার পাসপোর্ট দেখে চিনতে না পারায় অনেকবারই তাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে একটি প্রশ্নেরঃ “এটা কে?” প্রথম আলো তার ওজন কমানোর এই বিস্ময়কর ফলাফল নিয়ে একটা খবর বের করেছিলো যেখানে  তার আগের একটি ও নতুন একটি ছবি ছিল। এরপর হতে পত্রিকার সেই অংশটুকু কেটে নিয়ে, ওটা সাথে নিয়ে তিনি এয়ারপোর্টে যেতেন এবং তা দেখিয়ে বলতেন, “ ভাই সত্যি দেখেন! খোদার কসম এটা আমি! প্রথম আলো বলেছে!”

 

আপনার পারা না পারা, এই পুরো ব্যাপারটাই মানসিক

ওজন কমানোর যাত্রায় প্রথম যেদিন সুমন দেখলেন যে তার ১০-১২ কেজি ওজন কমে গেছে, তখন তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে তিনি আসলেই পারবেন। তিনি বিষয়টিকে ব্যাখা করেন এভাবেঃ “আমার ধারণা, আমি যদি প্রথম ১০-১২ কেজি কমাতে না পারতাম তাহলে হয়তো মনে হতো যে আমি আর পারবো না। তবে পুরা ব্যাপারটা কিন্তু আসলে কিছুই ছিল না। পুরাটাই ছিল আমার মানসিক চিন্তা(Mind set)। ব্রেইনে ছিল ব্যাপারটা যে আমি আসলে ওজনটা কমাতে পারবো। এটাতে যখন আমি নিজেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছি, নিজেই যখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, তখন আমি জিনিসটা করতে পেরেছি

অতএব, আপনার পারা না পারা, এই পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে আপনার মানসিকতার উপর।

আমি জীবনে অনেক ধরনের সমস্যায় পরেছি। অনেক সময় মনে করেছি যে “না! আমি বোধ হয় আমার সামনে যেই বাধা সেটা পার হতে পারবো না। কিন্তু তখনই আবার মনে হয়েছে যে, “আমি তো প্রায় ১০০ কেজি কমিয়ে ফেলেছি, তাহলে এটা পারবো না কেন? এটা কয়জন পারে, তাই না?” এই চিন্তাই আমাকে অনেক দূর এগিয়ে নেয় কারণ এটা আমার জন্যে অনেক বড় একটা ব্যাপার ছিল।

 

স্বপ্ন যখন শেষের পথে

২০০১ বা ২০০২ এর কথা। একটি কনসার্টে গান গাওয়ার সময়য় সুমন হা করে হঠাৎ বুঝতে পারেন যে মুখটা তিনি বন্ধ করতে পারছেন না। সত্যি সত্যিই প্রচণ্ড ব্যথায় মুখ বন্ধ হচ্ছে না। গান থামিয়ে ব্যাক স্টেজে গেলেন এবং বুঝলেন যে বাম পাশের চোয়ালে কোন একটা সমস্যা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত পরের দিনেই ব্যবসায়ের কাজে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল তার। সেখানেই ডাক্তার দেখানোর চিন্তা করলেন। টেস্টের পর ডাক্তার বলল “তোমার আসলে চোয়ালের কয়েকটা লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে এবং কয়েকটা একটু লম্বা হয়ে গেছে।” সুমনের তখন মনে পড়ে যায় ক’দিন আগের দুর্ঘটনা। পড়ে গিয়ে দরজার হাতলের সাথে তার  মুখে ভয়ংকর রকমের একটা বাড়ি খান তিনি। ক্ষতিটা হয়েছিলো তখনই, কিন্তু টের পাননি তিনি।

এরপর ডাক্তার যা বললেন তা শুনার জন্য খুবই অপ্রস্তুত ছিলেন সুমন। ডাক্তার বলল, “তোমার গান গাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। তুমি আর গান গাইতে পারবা না।”

তখন তাকে মুখের মধ্যে পড়ার জন্য দুইটা ব্রেইস দেওয়া হল যা ২৪ ঘণ্টা তাকে পরে থাকতে হবে- একটা দিনের বেলা, আরেকটা রাতে ঘুমানোর সময়।

রাতে ঘুমানোর সময় যেটা পরতে হতো সেটা পরার পর তার দম যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মনে মনে বলছিলেন, “এতো ভয়ংকর একটা জিনিস পরে আমি কীভাবে থাকবো?”

“একদম সত্যি কথা বলছি, সেদিন আমি কেঁদে দিয়েছিলাম এই মনে করে যে আমি তো আর গান গাইতে পারবো না, আমার জীবনটা আর স্বাভাবিক নেই”।

 

আমরা যা ভাবি, তাই হয়ে উঠি

কিন্তু কিছু না করে বসে থাকার ব্যাপারটা মানতে পারছিলেন না সুমন। তিনি চিন্তা করলেন, তাকে গান গাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রাতের বেলার ব্রেইসটা পরলে কোন কথাই বলা যেত না। আর দিনের বেলার ব্রেইস্টা পরে কথা বললে উচ্চারণগুলো বুঝা যেত না। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে সুমন ঘটালেন একটি চমৎকার কাণ্ড। তিনি বলেন, “এখন শুনে অবাক হবেন যে ১ বছর পর আমি মঞ্চে উঠে গান গেয়েছি এবং আমার মুখে ব্রেইস পরা ছিল কিন্তু কেউই টের পাই নি!”

ডাক্তারকে বলার পর সেও বিস্মিত হল। ডাক্তার শুনে বলল,

“এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার! আমি জানি না তুমি এটা কীভাবে করছ। তবে যেহেতু গাইতে পারছ, তাহলে গেয়ে যাও!”

এভাবেই তিনি গান গেয়ে যান এবং ৪ বছর পর ডাক্তার জানালেন যে তাকে আর ব্রেইস পরতে হবে না, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ।

তাই বলছি, এই পুরো জিনিসটা হচ্ছে একটা মাইন্ড সেট এর ব্যাপার। আমাদের চিন্তা করতে হবে যে আমি পারবো। যদি বলি যে পারবো না, তাহলে আসলেই পারবো না। আমাদের Mind over Body control এটাতে আমি অনেক বিশ্বাস করি। একটি উদাহরণ দিই। ধরুন আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। আপনি দৌড় দিয়ে গিয়ে একটা ছাউনির নিচে দাঁড়ালেন এই ভেবে যে গায়ে বৃষ্টি পরলে আপনি ভিজে যাবেন এবং আপনার জ্বর আসতে পারে। আপনি হয়ত ছাউনির কোণায় দাঁড়িয়েছেন, পাশ দিয়ে পানি পরে আপনার কাঁধ একটু ভিজে গেছে। আপনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন যে “ইশ! ভিজে গেলো কাঁধটা! যদি জ্বর আসে?” দেখবেন রাতের বেলা আপনার সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।

এখানে খেয়াল করুন, আপনি বৃষ্টির নিচে পনেরো মিনিট ছিলেন তাই আপনার জ্বর আসছে কিন্তু গোসলের সময় ঝর্ণার নিচে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও আপনার জ্বর আসে না। কারণ আপনি ভাবছেন যে আপনি তো গোসল করছেন, আপনার তো জ্বর আসার প্রশ্নই উঠে না। তাই বলছি, জিনিসটা আসলে মাইন্ড সেটের ব্যাপার। আপনি কীভাবে চিন্তা করবেন। আপনি চিন্তা করছেন যে আপনার জ্বর আসছে, জ্বর আসছে; আপনার হয়তো জ্বর আসে নাই কিন্তু আপনি মাথায় চিন্তা করছেন যে আমার গা তো গরম হয়ে গেছে আল্লাহ্‌! এখন কি হবে? কালকে সকালে অফিসে যাবো কীভাবে? অথবা, আল্লাহ্‌ আমার তো জ্বর আসছে। তো কাল অফিস যেতে হবে না, কী ভালো!

সুতরাং, “আমি এটা পারবো না। এভাবে চিন্তা করলে হবে না। আমি বেজ গীটার বাজাই সেই ১৯৮৮ থেকে। বেজ গীটার বাজাতে বাজাতে এক সময় মনে হল যে আমি তো অনেক ভাল বেজ গীটার বাজাই। তারপর এমন একটা বিষয় দাঁড়ালো যে আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে আমি তো ভালো বাজাই, আমার তাহলে আর চর্চা করার দরকার নেই। এবং সত্যি সত্যিই আমি ৮ বছর বেজ গীটার বাজাইনি। ভাবলাম বাজিয়ে কী হবে? আমি তো অনেক ভালো বাজাই। তবে একটা সময় মনে হল যে, আমি যেই লেভেলে বাজাই আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেই ভাবে বাজায়, ঐ পর্যায়ে যেতে হলে এটা আসলে অসম্ভব হবে। তাই যেটা বাজাচ্ছি, এখানে বাংলাদেশিরা বলছে যে ভালো বাজিয়েছি। তাই অতটুকু পর্যন্তই বাজিয়েছি। কখনো চিন্তা করি নি যে আমার আরেকটু বেশি ভালো করতে আরও চর্চা করতে হবে। কিন্তু একটা সময় এসে মনে হল যে জিনিসটা আসলে ঠিক হচ্ছে না। বাইরের গীটারিস্টদের তো আসলে আলাদা কিছু, এক্সট্রা কিছু নেই। তবুও তো ওরা আমাদের থেকে ভালো বাজাচ্ছে। গীটার একটা পশ্চিমা বাদ্য এবং আমি একজন পাশ্চাত্যের মানুষ না হওয়ায় যে আমি বাজাতে পারবো না, এমন তো হয় না।

তবে আমি ভাগ্যবান যে আমি NAMM (National Association of Music Merachants) show তে যাওয়ার আমন্ত্রন পেয়েছিলাম। এখানে বিশ্বজোড়া বড় বড় মিউজিক মার্চেন্টদের নিয়ে একটা মেলা হয়। এটি প্রতি বছর জানুয়ারিতে লস এঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত হয়  এবং এটিই সবচেয়ে বড় মিলনমেলা।

সেখানে যাওয়ার পর আমার ৫-৬ জন বেজ গিটারিস্টের সাথে পরিচয় হয়। খেয়াল করলাম ওরা প্রত্যেকেই খুব সাধারণ মানুষজন, খুবই মিশুক, খুবই সাধারণভাবে আমার সাথে কথা বার্তা বলছে। কিন্তু আমি বুঝলাম যে, ওরা যত ভালো বাজাতে পারে, তার কাছাকাছিও আমি নেই অথচ বাংলাদেশে থাকার সময় আমার যেন অনেক ভাব থাকে। ভাবি, “আরে আমি তো বেজ বাজাই। অনেকে আবার বেজবাবাও ডাকে আমাকে।” তাই তখন আমি তাদের ব্যাপারটা বুঝার জন্য তাদের সাথে আমি কথা বললাম। আমি সেখানে ৫-৬ দিন ছিলাম এবং প্রতিদিনই আমি তাদের সাথে ঘুরেছি, আড্ডা দিয়েছি। আমি যখন দেশে ফেরত আসলাম, দেখলাম যে আমি গীটার হাতে নিয়ে প্র্যাকটিস করা শুরু করেছি এবং এটার একমাত্র কারণ ছিল ঐ ৫-৬ জনের সাথে আমার  কয়েকদিনের জন্য থাকা।

এর কয়েকদিন পর আমি নিজের একটা ইন্সট্রুমেন্টাল তৈরি করে অনেক নামকরা একজন বেজ গিটারিস্টকে রেকর্ড করে পাঠালাম। সে বলল যে এটা খুবই ভালো হয়েছে এবং সে নিজেও এটাতে বাজাতে চায়। আমি প্রথমে চমকে গেলাম। পরে জানালাম যে এটা আমার জন্য সত্যি খুব গর্বের বিষয় যে তুমি কাজ করতে চেয়েছ আমার সাথে। তাই দুদিন পরেই সে আমার এই টিউনটা রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিল আমাকে।  আমি চিন্তা করলাম যে যেহেতু সে বলেছে এটা ভালো, তার মানে নিশ্চয়ই আমি ভালো কিছুই করেছি। তাই ভাবলাম আমি এরকমভাবেই আরেকটা বানানোর চেষ্টা করি। তখন আরেকটা বানালাম। এভাবে করতে করতেই এখন তাদের সাথে মিলেই আমরা একটা ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবাম বের করলাম যা কিছুদিন আগেই আমেরিকাতে রিলিজ হয়েছে। আমি এমন একটা অ্যালবাম করার পরিকল্পনা করেছি প্রায় ১৭ বছর ধরে। কিন্তু আমার কাজ যদি ভালো না হয় এই ভয়ে আমি করিনি। তবে শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমি করেছিই। এখানে যেই ৮-১০ মিউজিশিয়ান আমার সাথে বাজিয়েছে, আমি এক সময় স্বপ্ন দেখতাম তাদের একটা কনসার্ট সরাসরি একদিন দেখতে পারেলেই আমার জীবন সার্থক হবে। আর আজ সেখানে কি না তারাই আমার বন্ধু! এই ব্যাপারটি আমার জন্য খুব বড় একটা বিষয়। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে শুধু আমার এই চিন্তার কারণেই যে আমি চেষ্টা করেছি এবং মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি যে “হ্যাঁ আমি পারবো”।

 

ডিয়ার ক্যান্সার, আমি কেন?

আপনারা অনেকেই জানেন যে আমি ৬ বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলাম। যেদিন ক্যান্সার ধরা পরে, ডাক্তার যখন বলে যে আমি স্টেজ-২ এ আছি, আমার মেরুদন্ডে দুটি টিউমার। কয়দিন বাঁচবো জিজ্ঞেস করাতে বলল যে লিফনডে যদি চলে যায় তাহলে বেশি দিন বাঁচবো না, আর যদি না যায় তাহলে আশা রাখা যাবে। দেশে ফেরত এসে প্রথম ১৫ দিন আমি দরজা-জানালা বন্ধ করে শুধু কেঁদেছি আর ভেবেছি। খুব মন খারাপ ছিল কারণ কাউকে বলতেও পারছিলাম না। সারাক্ষণ শুধু মৃত্যুর চিন্তা মাথায় আসছিল। আমার পরিবারের বেশ কয়েকজন মানুষের ক্যান্সার ছিল এবং তারা খুব কম বয়সেই মৃত্যু বরণ করে। আমারও কি তাহলে একইরকম হবে? এই শঙ্কা হতে আরও কাঁদতে লাগলাম।

এরই মধ্যে আমার একজন বন্ধু নিউ ইয়র্ক থেকে সিঙ্গাপুরে এসেছিল। আমার অসুস্থতার কথা শুনে সে বাংলাদেশে আসে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে। সে এসে আমাকে বুঝালো যে এটা কোন ব্যাপার না, জীবনে এমন অনেক কিছু হয়। আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রেরনামূলক কিছু কথা বলল এবং সেটা আমার ঐ মুহূর্তে খুব প্রয়োজন ছিল। তার কথা গুলো আমাকে মারাত্মকভাবে অনুপ্রেরিত করে। সে নিজেই ১-২ বছর পর মারা যায় কেননা সেও তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল।

আমরা কেউই বলতে পারি না যে আমরা কে কতদিন বাঁচবো, কোথায় কী হবে না হবে। আমার বান্ধবী তার নিজের কঠিন মুহূর্তের মধ্যেও আমাকে অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছিল। তাই আমি মনে করি যে আমরা যারা কঠিন  সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তাদেরকে বলা উচিত যে তুমি এই খারাপ সময়টাকে কীভাবে গ্রহণ করবে এটা তোমার ব্যাপার। তুমি যদি কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে দাও, তাহলে এর মধ্যে সমস্যা আছে।

শেষ ৬ বছরে আমি ১২ বার অপারেশন থিয়েটারে গিয়েছি শুধুমাত্র এই ক্যান্সারের জন্য। আমার মেরুদণ্ডে ও মস্তিষ্কে টিউমার ছিল, কিডনিতে সমস্যা ছিল,  পুরো শরীরে লাই্পোসারকোমা ছিল। আমার পেটে অর্থাৎ স্টোমাকে ক্যান্সার ছিল, ৮৫% স্টোমাক ইতোমধ্যেই ছিল না। কেটে ফেলে দিতে হয়েছে ক্যান্সারের জন্য। এতোগুলো রোগের মাঝ দিয়ে আমি গিয়েছি। শেষ পর্যন্ত ২-৩ সপ্তাহ আগে ডাক্তার বলল যে আমি সম্পূর্ণ ক্যান্সারমুক্ত এবং আগামী ১ বছর কোন টেস্ট না করালেও চলবে।

তবে আমি এখন ঠিক আছি বলে যে আমি আগামীতেও ঠিক থাকবো এমন কোন কথা নেই। মূল কথা হল, আমাকে সবসময় ইতিবাচক থাকতে হবে। আমার এমনও হয়েছে যে সামনে আমার সার্জারি হবে কিন্তু আমি তখন আমেরিকায় গিয়ে ১৪ হাজার মাইল নিজে গাড়ি চালিয়ে ২৮টা রাষ্ট্র ঘুরেছি। আমার চিন্তা একটাই ছিল যে, আমি যদি মারা যাই, তাহলে তো এগুলো আর দেখা হবে না তাই এখনই দেখে রাখি। আমি চাইলে তখন বসে মানুষের কাছে কান্নাকাটি করতে পারতাম এবং সহমর্মিতা চাইতে পারতাম। তবে আমার মনে হয়েছে যে নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা নিয়ে থাকলে আমি আজ বেঁচে থাকতাম না।

একজন মানুষের জীবনে অনেক কিছুই আসে। সবাই বলে যে you live only once তবে আমি বলি যে you live twice। একবার যখন তুমি জন্ম নাও, আরেকবার যখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও যে তুমি কিভাবে চলবে। আমি কীভাবে বাঁচব এটা আমার চিন্তা করতে হবে।

অনেকেই ভাবতে পারেন যে কি লাভ হচ্ছে এতো কথা শুনে। আমি বলবো যে, এগুলো শুনা প্রয়োজন, কেননা আমি নিজেই মাত্র ৫-৭  দিন আমার ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন বন্ধুর কথা শুনেই আমার জীবন বদলাতে পেরেছি, হয়ত আমার কথা আপনাদের জীবনেও কোন কাজে আসতে পারে।

Watch the full video here

Content contributor: Fabiha Bushra

Related Posts

Leave a comment